উৎকৃষ্টের জন্য বোধ ও বোধির মাত্রাকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা করে আসছে মানব সমাজ। এ চেষ্টা কখনো ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস থেকে, কখনো প্রকৃতি থেকে ধারণ করে মানব সমাজ সে প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বৃহত্তর কল্যাণের জন্য মানব সভ্যতার ক্রমাগত এ প্রয়াস চর্চিত হয়ে আসছে নানা রূপে। সাহিত্য এরই একটি অনন্য ক্ষেত্র। প্রকৃতির কাছাকাছি সাহিত্যের অনন্য ধারা বেগবান হয়ে উঠে। মানব মনের অনেক জিজ্ঞাসার সন্ধান মানুষ প্রকৃতির কাজেই খুঁজে নিতে চায়। বেংগলি ইন্টারনেশনাল লিটারারি সোসাইটি আয়োজিত ২য় রকল্যান্ড রিট্রিট এন্ড বুক ফেয়ার আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তরা এসব কথা বলেছেন। ২৭ জুলাই নিউইয়র্ক নগরকেন্দ্রের অদূরে বাংলা ভাষার লেখক, সংস্কৃতিসেবী ও অগ্রসরজনদের নিয়ে দুই দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়। নিউইয়র্কের একদম কাছেই রকল্যান্ড কাউন্টিতে চেস্টনাট রিজ নামের এক গ্রাম। পাহাড়, টিলা আর সবুজ অরণ্যের এ গ্রামের লোকজন বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান দার্শনিক রুডলফ স্টেইনারের জীবনাদর্শে উজ্জীবিত। আমেরিকার বাইরের জগৎ থেকে ভিন্ন তাদের জীবনধারা।ব্যক্তিগত বিশ্বাস,অবিশ্বাস, প্রকৃতি,সাহিত্য, বোধ ও বোধির ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ভিন্ন চিন্তা ও চর্চাকে প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রিক কল্যাণের জন্য এ গ্রামের লোকজন নিবেদিত। আমেরিকার এ গ্রামে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় অনেকটা গ্রাম বাংলার রূপ। ঘোড়া গরু চরানো মাঠ।কিষাণীর নির্মল হাসি।বৃক্ষরাজি আর টিলার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার ঝিরঝিরে জলরাশি। হরিণ শাবকের দৌড় ঝাঁপ। গ্রামের প্রতিটি মানুষ ভাবাদর্শে ও নিত্য দিনের চর্চায় একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। সকলের তরে যেন সকলে সবাই। এ গ্রামে বসবাস করেন ড.ধনঞ্জয় সাহা।ডিসি সাহা নামের বাংলাদেশি এ বিজ্ঞানি ও কবি এবং তার স্ত্রী ডা:অনিমিতা সাহা চেস্টনাট রিজ গ্রামের বহুজাতিক এ গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাসিন্দা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাদেরই উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় গত বছর থেকে এ গ্রামে বেংগলি ইন্টারনেশনাল লিটারারি সোসাইটি বাংলা বইমেলা ও লেখকদের নিয়ে চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে।
'বোনের মাঝে- লেখার খোঁজে' শিরোনামে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা কার্যত শুরু হয়ে যায় শুক্রবার রাত থেকেই। অনেক লেখক ও সংস্কৃতিজন শুক্রবার রাতেই পাড়ি দেন ত্রিফোল্ড কমিউনিটি সেন্টারের আবাসন আয়োজনে। সার্বজনীন অথিতিশালায় রাত যাপনের অথিতি এবং স্থানীয় বহুজাতিক বাছাই করা লোকজনকে নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানান সাহা দম্পতি। এ আমন্ত্রণে যোগ দিয়ে দেখা যায়, উপস্থিত হয়েছেন স্থানীয় পাদ্রি থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজন। সম্পূর্ণ জৈব খাবারে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন অভ্যাগতরা। আলাপ হচ্ছে শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের লেখা ও ভাবাদর্শ নিয়ে।
শনিবার সকালেই ব্রেকফাস্টের পরই গণশরীরচর্চায় যোগ দিলেন সবাই। নিয়ম মেনে হালাকা ব্যায়ম করে শরীরকে কেমন করে দিনের জন্য প্রস্তুত জরতে হয়, তার একটা অনুশীলন দিয়ে দিনের শুরু হয়। এরপরই ছিল পাহাড় জঙ্গল দিয়ে মাইল খানেক হেঁটে যাওয়া, সবুজ মাঠে বসে ইয়োগা অনুশীলনের আসর। দল বেধে খামার দর্শন, গরু ঘোড়া, হাস মোরগের খামার দেখে অভ্যাগতরা স্থানীয়দের সাথে প্রাকৃতিক ছড়াউ সাঁতার কাটতে নামেন।
বিকেল ৩ টায় সুসজ্জিত মঞ্চ থেকে সবাইকে অনুষ্ঠানমালায় আনুষ্ঠানিক স্বাগত জানান ড. ধনঞ্জয় সাহা। কথা বলেন ২য় বারের মতো এ আয়োজনের আহ্বায়ক তরুণ সংগঠক গৌতম সাহা। অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক যোগ দেয়া প্রধান অতিথি নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই বহু জাতী, বহু বিশ্বাসের নিয়ামক বিষয়গুলোর সমৃদ্ধ সবস্থান রয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা অনন্য যে কাজ করছেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রকল্যান্ডের এ বাংলা বইমেলা বলে তিনি উল্লেখ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রেভারেন পল নিউম্যান, ড শান্তনু দাস, জেনেথ রট্রিগার্স প্রমুখ। ব্রিটিশ আমেরিকান পাদ্রী পল নিউম্যান বলেন তারা বাবা অক্সফোর্ডের শিক্ষক ছিলেন। ছেলে পলকে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী উপহার দিতেন। সে থেকে তার রবীন্দ্রনাথকে জানা।
জেনেথ রট্রিগার্স এন্থোপ্রসি নামের ভাবাদর্শ এবং বিশেষায়িত মানুষদের নিয়ে কথা বলেন। উল্লেখ্য, একটি ভিন্ন ধর্মী বিশেষায়িত স্কুল পরিচালিত হয় এ গ্রামে। যেখানে বিশেষায়িত শিশু এবং মানুষদের নিয়ে জীবনব্যাপী দেখভালের কাজ করা হয়। উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে লেখকদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। লেখকদের মধ্যে কবি ফকির ইলিয়াস, শহীদ রাজু, ফারহানা ইলিয়াস তুলি, জান্নাতুল ফেরদৌস, মিজানুর রহমান, ড্যানিয়েল কার্টার, শেখর কর্মকার, দীপা নাথ, দিলীপ নাথ, অমিয় দাশ, ইব্রাহীম চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদাকে নিয়ে বিশিষ্টজন বইমেলার উদ্বোধন করেন। আড্ডায়, আলোচনায় এবং পরিচিতি বিনিময়ের মাধ্যমে সবুজ প্রান্তরে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে চমৎকার সময় কাটে সুধীজনদের। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় জৈব আহার। কবি ফকির ইলিয়াসের সঞ্চালনায় সাহিত্য আড্ডা অনুষ্ঠানে কবিরা কবিতা আবৃত্তি করেন, কেউ ছড়া পাঠ করেন বা কেউ সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেন।