বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তী গণ অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থণ করে সমাবেশ করেছেন নিউইয়র্কের পেশাজীবি বাংলাদেশী-আমেরিকানরা। রোববার (৪ আগষ্ট) বিকেলে জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে প্রবাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী অংশ নেন। এসময় তারা নানা শ্লোগান দেন এবং কোটা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান এবং শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবী করেন। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, পিপল আপ, পেট্রিয়ট পিপলস অব বাংলাদেশ প্রভৃতি সংগঠন ছাড়াও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী সহ সর্বস্তরের পেশাজীবীরা এই সমাবেশের প্রতি সমর্থন জানায়। সমাবেশের সমন্বয়ক ছিলেন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান, ডা. সৈয়দ আল আমীন রাসেল এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ইমরান আনসারী। তাদের যৌথ পরিচালনায় সমাবেশ শেষে প্রস্তাবনা পাঠ করেন ডা. ওয়াজেদ এ খান। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রবাসী বাংলাদেশী-আমেরিকান পেশাজীবিদের এতো বড় সমাবেশ এই প্রথম। খবর ইউএনএ’র।
সমাবেশে বক্তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলি ও সহিংসতায় নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা এবং গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আজকের বাংলাদেশ দেখার জন্য একাত্তুরে দেশে লাখো মানুষ প্রাণ দেয়নি। বাংলাদেশ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এই দেশ সকল মানুষের। আমাদের দূর্ভাগ্য কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি বরং দেশ আর রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নিজের বলে মনে করেছে। কিন্তু দেশের তরুণ সমাজ আজ নতুন বাংলাদেশ গড়েছে। বক্তারা অতীতের শিক্ষা থেকে বৈশষম্যহীন, শোষণহীন জনগণের বাংলাদেশ গড়ার প্রতি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাবেশে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রবীন সাংবাদিক, সাপ্তাহিক আজকাল-এর প্রধান সম্পাদক মনজুর আহমদ, অধ্যাপক ড. শওকত আলী, ডা. জুন্নুন চৌধুরী, ডা. রুমানা সবুর, ডা. মামুন, সিনিয়র সাংবাদিক মঈনুদ্দীন নাসের ও সাঈদ তারেক, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা’র সম্পাদক টাইম টেভিশন-এর সিইও আবু তাহের, সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক সম্পাদক রতন তালুকদার, সাপ্তাহিক প্রথম আলো সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট মিনা ফারাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফার্মাসিস্ট সৈয়দ টিপু সুলতান, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মমিন মজুমদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান ও খন্দকার ফরহাদ, মানবাধিকার কর্মী রীটা রহমান ও মাহবুবুর রহমান, জেবিবিএ’র সভাপতি গিয়াস আহমেদ, এডভোকেট মুজিবুর রহমান, কবি জহিরুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার মোমসেক বিল্লাহ লেখক-সাংবাদিক মনিজা রহমান ও রওশন হক, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট আজিজুল হক, কাজী ফৌজিয়া ও ওসমান চৌধুরী, সঙ্গীত শিল্পী বেবী নাজনীন ও বিপ্লব, সাংস্কৃতিক কর্মী এনাম চৌধুরী, বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের অবনী ও সমাবেশ আয়োজনকারী অন্যতম সমন্বয়ক সহ আরো অনেকে। সমাবেশে কবিতা আবৃত্তি করেন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট আহসান হাবীব, সাংবাদিক ডা. সজল আশফাক, ছড়াকার শাহ আলম দুলাল ও তাসমিনা। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তাদের সংহতি প্রকাশ ও সমর্থণ জানান।
সমাবেশে পঠিত প্রস্তাবনায় বলা হয়: আমরা আজ ক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠিত বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের জন্য। আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে বিরামহীন। আপনারা জানেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ অতিক্রম করছে স্মরণকালের ভয়াবহ ক্রান্তিকাল। হোলি খেলা চলছে রক্তের। লাশে লাশে সয়লাব রাজপথ-সবুজ জমিন। গোটা দেশ জ্বলছে দ্রোহের আগুনে। কি ভয়ঙ্কর বিভৎস সহিংসতা। শেখ হাসিনা অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজ দেশ, নিজ জাতি, নিজ ভাষাভাষী মানুষকে হত্যা করছেন নির্মম নৃশংসভাবে। ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আজকে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে বাংলাদেশে প্রাণহানি ঘটেছে শতাধিক মানুষের। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা চারশ ছুঁই ছুঁই করছে। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার সেলে চিরদিনের জন্য দৃষ্টি হারিয়েছেন সহস্রাধিক। সরকার জেলে পুরেছে ১২ হাজার মানুষ। এজন্য সরকার ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার। রাজপথের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ মনে করিয়ে দিচ্ছে মধ্য যুগের বর্বরতা।
ক্ষমতার দম্ভ ও অহমিকায় অন্ধ শেখ হাসিনা প্রয়োগ করেছেন সর্বশক্তি। চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বিচার গণহত্যা। ছাত্র জনতার বিল্পবকে নস্যাৎ করে দিয়ে দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছেন অবৈধ ক্ষমতা। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরেধী আন্দোলন এখন গড়িয়েছে গণভ্যুত্থানে। শিক্ষার্থীরা ডাক দিয়েছে স্বৈরশাসন অবসানের। তারা কর্মসূচী দিয়েছে ঢাকা মার্চ ও গণভবন দখলের। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বর্হি:প্রকাশ ঘটেছে দীর্ঘ দেড় দশকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের। অনিবার্য পরিণতি ঘটেছে অধিকার ও গণতন্ত্রহীন রাজনীতি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। দেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ তাদের নাগরিক অধিকারের দাবিতে শামিল হয়েছে এক কাতারে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে শিক্ষার্থীরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে বরণ করছে শাহাদাত। তাদের এই আন্দোলনে সমর্থন, সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন দেশ ও প্রবাসের সকল শ্রেনী পেশার মানুষ।
সব মতভেদ ভুলে সব বয়সের নারী পুরুষ দখল নিয়েছে রাজপথের। ভারতীয় উপমহাদেশে বিগত দু’শতাব্দীতে এমন আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রাণহানির ঘটনা নজিরবিহিন।
বাংলাদেশে নবজাগরনের সৃষ্টি করেছে শিক্ষার্থীরা। তারা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার হরণ ও নিপীড়ন নির্যাতন করে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যায় না। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রমাণ করেছে তাদের দেশপ্রেম। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রাম এখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। সন্তানদের স্বপ্ন-আশা-আকাংখা ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য দেশ ও প্রবাসে যে যেখানেই থাকিনা কেন দাঁড়াতে হবে তাদের পাশে। সর্বশেষ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও সমর্থন জানিয়ে একাত্নতা প্রকাশ করেছেন আন্দোলনের প্রতি। ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে বিবেকবান কোন বাংলাদেশী নিরব থাকতে পারেন না। তাই আমরা নিউইয়র্কে বসবাসকারী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশীরা এখানে সমবেত হয়েছি নতুন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনকারী সৈনিকদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে।
আজকের এই সমাবেশ থেকে আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি, কোন ব্যক্তি, পরিবার, বা দল নয় আপনারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করুন। আন্দোলনকারীরা আপনার, আমার, অত:পর আমাদের ভাই-আমাদের সন্তান। আপনারা তাদের পাশে দাঁড়ান । দেশ ও জাতির প্রতি সঠিক সময়ে পালন করুন সঠিক দায়িত্ব। স্বৈরশাসকের পতনের কোন বিকল্প নেই এই মুহূর্তে। খুনীদের দায়মুক্তি ও পালানোর সব পথ বন্ধ করুন। বাংলাদেশ কোন অধিকৃত ভূখন্ড নয়। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান সফল হোক। নিপাত যাক স্বৈরাচার। মুক্তিপাক গণতন্ত্র। অবসান হোক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার। হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত প্রবাসীরাও চালিয়ে যাবে আন্দোলন। এটাই অঙ্গীকার হোক আজকের সংহতি সমাবেশের।