স্বপ্নজয়ের লড়াই :  আমেরিকা প্রবাসী বাবুর অদম্য সাফল্যের গল্প 

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৫৮
স্বপরিবারে খোরশেদ আলম বাবু

সফলতা কোনো এক রাতের গল্প নয়,এটি অর্জন করতে হয় ধৈর্য, নিষ্ঠা, পরিশ্রম, এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে লেগে থেকে। যারা আজকের দিনে সফল হয়েছেন, তাদের এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে ব্যর্থতা, ত্যাগ, এবং সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। আমরা সবাই বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত সফল মানুষদের নাম জানি, কিন্তু তাদের সাফল্যের নেপথ্যের গল্পগুলো কতটুকু জানি? এই লেখায় আমরা এমন একজন মানুষকে নিয়ে আলোচনা করবো যিনি জীবনের চড়াই-উতরাই, নানা চ্যালেঞ্জ ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং সফলতার শিখরে পৌঁছেছেন। তিনি হলেন খোরশেদ আলম বাবু, এক জীবনযুদ্ধে জয়ী সৈনিক, যিনি নিজের কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন নিজের সফলতার গল্প। শৈশব থেকেই বাবু ছিলেন স্বপ্নবাজ।
স্কুলের পড়াকালীন সময়ে, যখন শিক্ষকরা জানতে চাইতেন তার জীবনের লক্ষ্য কী, তখন তার সহপাঠীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট কিংবা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু বাবুর স্বপ্ন ছিল আলাদা—তিনি আমেরিকা যেতে চেয়েছিলেন, প্রচুর অর্থের মালিক হতে চেয়েছিলেন। বাবুর স্বপ্ন ছিলো বড়, এবং সেই স্বপ্নের পেছনে তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ১৯৮০-এর দশকে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের কাছে আমেরিকা ছিলো এক সোনার হরিণ। আমেরিকা যাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া যেমন ছিল কঠিন, তেমনি কঠিন ছিল সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা। বাবুও এ স্বপ্ন পূরণের পথে বহুবার ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু কখনো হতাশ হননি। তার মনোবল ছিল দৃঢ়, আর সে কারণেই একদিন সে স্বপ্ন সত্যি করার জন্য জীবনকে বাজি রাখতে পেরেছিলেন। এইচএসসি পাস করার পর বাবু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র আমেরিকা যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার অনেক চেষ্টার পরও সফল হতে না পেরে, বাবু সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি অন্যভাবে চেষ্টা করবেন। বাবুর এক ফুফার সহযোগিতায় তিনি আমেরিকা গামী একটি জাহাজে ক্লিনারের চাকরি নেন। সেই জাহাজে বাবু জীবনের প্রথম সত্যিকারের সংগ্রাম শুরু করেন, যেখানে তাকে সহ্য করতে হয়েছিল কঠোর পরিশ্রম এবং অবর্ণনীয় কষ্ট। ১৯৮৬ সালে, জাহাজটি আমেরিকার বন্দরে নোঙর করে। বাবুর হাতে তখন মাত্র ২০ ডলার ছিলো, যা দিয়ে তিনি জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউইয়র্কের এক বাঙালির বাসায় ওঠেন। জীবনের নতুন যাত্রা শুরু হয় তার। আমেরিকার কঠোর বাস্তবতা তাকে নতুন করে জীবন যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেয়। বাবু কাজ শুরু করেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। ১৯৮৬ সাল থেকে বাবু নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে শুরু করেন। কাজের প্রথম দিনই তার মনে গভীরভাবে গেঁথে যায়; ৫০ কেজির বস্তা মাথায় নিয়ে চারতলায় উঠার সেই অভিজ্ঞতা আজও তার চোখে জল এনে দেয়। জীবনের প্রথম দিনেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আমেরিকার মাটিতে টিকে থাকা কতটা কঠিন। তবে বাবু কখনো থেমে থাকেননি। তিনি নিজেকে প্রতিদিন আরও শক্তিশালী করে তুলতে থাকেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে একদিন তিনি নিজেই কনস্ট্রাকশন ব্যবসার মালিক হবেন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে সততার সাথে কাজ করে তিনি পুরো কাজের কৌশল ও অভিজ্ঞতা রপ্ত করেন। তার দক্ষতা, পরিশ্রম, এবং সততার প্রতি অঙ্গীকার তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। এই সময়ে তার জীবনে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তিনি এক আমেরিকান ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন, যার নাম এনমেরি আলম। এই বিয়ে তার জীবনে শুধু এক নতুন সম্পর্কই নয়, বরং নতুন সম্ভাবনারও দ্বার উন্মোচন করে। ১৯৮৮ সালে বাবু ও তার স্ত্রী মিলে ডেফোডিল কনস্ট্রাকশন ফার্ম নামে একটি কনস্ট্রাকশন ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার প্রথম দিকে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। আর্থিক সংকট, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা, এবং কর্মীদের সাথে সামঞ্জস্য বিধান—সবকিছুই ছিল কঠিন। কিন্তু বাবু কখনো হাল ছাড়েননি। তার স্ত্রীও এই যুদ্ধে ছিলেন তার অন্যতম সহযোদ্ধা। তাদের কঠোর পরিশ্রম, সততা, এবং কর্মীদের প্রতি যত্নশীল মনোভাব তাদের ব্যবসাকে ধীরে ধীরে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম দিকে কাজ পেতে নানা ধরনের অসুবিধা ছিল। বাবুর ব্যবসা ছোট, পুঁজির অভাব ছিল। তবুও তার দৃঢ় মনোবল এবং সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক কৌশল তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ব্যবসার শুরুতে অর্থাভাব এবং ঝুঁকির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকলেও, বাবু কখনো পিছু হটেননি। নিজের সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন তিনি। ধীরে ধীরে ডেফোডিল কনস্ট্রাকশন ফার্ম একটি পরিচিত এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাবুর জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও নিষ্ঠা। এই গুণগুলোর জন্যই তিনি সকল বাধাকে জয় করতে পেরেছিলেন। ডেফোডিল কনস্ট্রাকশন ফার্ম আজ নিউইয়র্কের অন্যতম সফল নির্মাণ কোম্পানি। বাবু ও তার সহধর্মিনী দু'জনই কঠোর পরিশ্রম করে তাদের প্রতিষ্ঠানকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। তাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা, নেতৃত্বের গুণাবলি, এবং কর্মীদের প্রতি আন্তরিকতা তাদেরকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। বাবু তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই প্রমাণ করেছেন যে ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে কোনো বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও খোরশেদ আলম বাবু কখনো নিজেকে সমাজের দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। তিনি একজন সমাজসেবক এবং মানবিক কাজের জন্যও সুপরিচিত। তার ব্যবসার আয় থেকে তিনি অনেক মানবিক এবং সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান, এবং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অবদান রাখার মাধ্যমে তিনি একজন দায়িত্বশীল সমাজকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাবুর ব্যক্তিগত জীবনেও সততা, দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসার মিশ্রণ দেখা যায়। তার তিন সন্তান—দুই মেয়ে ও এক ছেলে—উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত। বাবুর জীবনের এই সফলতা শুধুমাত্র তার নিজের নয়; এটি তার পরিবারের সকল সদস্যের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের ফল। খোরশেদ আলম বাবুর জীবন কাহিনি আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনের প্রতিটি ব্যর্থতা এক একটি শেখার সুযোগ এবং প্রতিটি সংগ্রাম সাফল্যের দিকে এক একটি ধাপ। তার জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে, সাহস জোগায়, এবং শিখায় যে কোন বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব যদি থাকে আত্মবিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি, এবং কঠোর পরিশ্রমের মিশেল। বাবুর মতন একজন সংগ্রামী মানুষকে দেখে আমরা উপলব্ধি করি যে, সফলতা কোনো রাতারাতি অর্জিত জিনিস নয়; এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা শুধুমাত্র অধ্যবসায় এবং দৃঢ় মনোবলের দ্বারা সম্ভব। খোরশেদ আলম বাবু আমাদের সকলের জন্য এক প্রেরণার নাম, যার জীবন যুদ্ধ ও সাফল্যের কাহিনি আমাদের সবসময় মনে করিয়ে দেয় যে 'সফলতার কোনো শর্টকাট নেই'। তার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।