শ্রমিক আন্দোলনের জন্ম আমেরিকায়। উনিশ শতকের শেষভাগে মালিকের বুটের নিচে শ্রমিকের হাহাকার থেকে যে দাবানল ছড়িয়েছিল, তা পাল্টে দিয়েছিল গোটা বিশ্বের শ্রমব্যবস্থা। আট ঘণ্টা কাজের দাবি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি—এসব রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্বজুড়ে ১ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—যে দেশে এই আন্দোলনের জন্ম, সেই যুক্তরাষ্ট্রে ১ মে নয়, সেপ্টেম্বরে পালিত হয় লেবার ডে। গ্রীষ্মের শেষে এক দীর্ঘ উইকেন্ড, পরিবারের সাথে আনন্দ আর ছুটির আবহেই এখানে “শ্রম দিবস”। ইতিহাসের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা শ্রমিকের রক্ত, ঘাম আর কান্নার দাগ সেখানে কোথাও নেই।
প্রশ্নটা সোজা—শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিকের রক্তের দাগ দেখালে তো পুঁজিবাদের মার্কেটিং ক্যালেন্ডারের সঙ্গে খাপ খায় না। ১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকদের স্মৃতি, অথবা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে শ্রমিক বিদ্রোহের রক্তাক্ত পটভূমি মনে করিয়ে দিলে রাষ্ট্র ও করপোরেট স্বার্থ অস্বস্তিতে পড়ত। তাই খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে এক নতুন দিন নির্ধারণ করা হলো—সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার।
এখানে শ্রম নেই, আছে ছুটি; আছে ডিসকাউন্ট সেল, শপিং মলের ভিড়, বারবিকিউর ধোঁয়া আর হাইওয়েতে ট্রাফিক জ্যাম। শ্রমের সম্মান নয়, আসল উৎসব হয়ে উঠল ভোগের। আজকের আমেরিকায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর শক্তি ভীষণ সীমিত। ইউনিয়নগুলো আছে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তাদের আওয়াজ ক্ষীণ। একদিকে প্রযুক্তির আগ্রাসন, অন্যদিকে করপোরেট লবির দৌরাত্ম্য শ্রমিক সংগঠনকে কোণঠাসা করেছে।
৯৫ শতাংশ আমেরিকান শ্রমিক লেবার ডে মানে শুধু ছুটি হিসেবে দেখে। পরিবারের সাথে একদিন কাটানো, শপিং মলে ছাড় পাওয়া, অথবা গ্রিলে মাংস পোড়ানোই তাদের কাছে মূল আকর্ষণ। বাকিরা ব্যস্ত শেয়ারবাজারের ওঠা-নামা বা অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে। শ্রমিকের অধিকার বা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সেখানে হারিয়ে গেছে।
মালিক শ্রেণী বা করপোরেট আমেরিকা খুব কৌশলে শ্রমিককে বোঝাতে পেরেছে—লেবার ডে মানে শ্রম নয়, বরং আনন্দ আর ভোগ। ছুটির দিন মানে নতুন গাড়ির বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সেল, ইলেকট্রনিক্সের ডিসকাউন্ট, কিংবা টিভি পর্দায় ফুটবল ম্যাচ। এমনকি শ্রমিকও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—আমি স্বাধীন, আমি সুখী, কারণ আমি ভোগ করতে পারছি। কিন্তু আসলে সে কেবল বাজারের মহা নাটকের এক্সট্রা অভিনেতা।
অবশ্যই অস্বীকার করা যায় না যে শ্রমিক আন্দোলন আমেরিকা ও বিশ্বকে অনেক কিছু দিয়েছে। আট ঘণ্টা কাজের নিয়ম, ন্যূনতম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা আইন—সবই এসেছে সংগ্রামের ফল হিসেবে। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে সেসব অর্জন যেন অতীতের গল্প।
গিগ ইকোনমি বা উবার-ডোরড্যাশের মতো কাজের জগতে শ্রমিকরা কোনো স্থায়ী নিরাপত্তা পান না। স্বাস্থ্যসেবা ও অবসরের নিশ্চয়তা অনেকের নেই। করপোরেট লাভ বেড়ে চললেও শ্রমিকের মজুরি সেই অনুপাতে বাড়ছে না।
তবু সমাজে যেন এক ধরনের নীরবতা নেমে এসেছে। শ্রমিক সংগঠন দুর্বল, আর সাধারণ মানুষ ভোগের আনন্দে ডুবে আছে। ফলে লেবার ডে একেবারেই বাজারকেন্দ্রিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে ১ মে এখনও শ্রমিক আন্দোলনের স্মৃতি বহন করে। সেদিন রাস্তায় নামে শ্রমিক, হয় সভা-সমাবেশ, উত্থাপিত হয় অধিকার আদায়ের স্লোগান। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এ দিন শ্রমিকের দাবি-দাওয়ার প্রতীক হয়ে আছে। কিন্তু আমেরিকায়? এখানে শ্রমিক দিবস মানে কোনো দাবি নয়, বরং শপিং মলের দরজায় “লেবার ডে সেল” লেখা পোস্টার।
কোনো জাতি যদি তার ইতিহাস ভুলে যায়, তবে সে জাতি সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়। আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসকে আড়াল করার মধ্য দিয়ে শ্রমিককে তার শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এক সময় যে আন্দোলন সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, আজ তার জায়গা নিয়েছে ভোগের উৎসব। এই বাস্তবতা কেবল আমেরিকার নয়, বরং বৈশ্বিক এক সতর্কবার্তা। শ্রমিক যদি ইতিহাস ভুলে যায়, তবে তার অধিকারও হারিয়ে যায়।
আমেরিকার লেবার ডে আমাদের শেখায়—পুঁজিবাদ কেবল শ্রমিকের ঘামই নয়, তার ইতিহাসও গ্রাস করে নিতে পারে। যে দিনে শ্রমিকের সংগ্রাম স্মরণ করার কথা, সেই দিনকে ছুটি, সেল আর ভোগের দিনে পরিণত করা হয়েছে। তবু আশা থাকে—যতদিন শ্রমিক বেঁচে আছে, ততদিন তার সংগ্রামের ইতিহাসও বেঁচে থাকবে। হয়তো একদিন আমেরিকান শ্রমিকও আবার প্রশ্ন তুলবে—লেবার ডে আসলেই কী? শুধু ছুটি, নাকি শ্রমিকের রক্তে লেখা ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা?