প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণতন্ত্রের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে তার মূল শিকড়ে আঘাত হানার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোটাধিকার চর্চার এক অনিবার্য অংশ—ডাকযোগে ভোট—বন্ধের পরিকল্পনা তাঁর নতুন রাজনৈতিক অভিযাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। এই পদক্ষেপকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই নয়, আমেরিকার বহু পুরনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি প্রশ্নচিহ্ন বলে বলা হচ্ছে।
১৮ আগস্ট সোমবার টেক্সাসের অস্টিনে বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে জনসমাগম হয়েছিল। নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে যে উত্তেজনা চলছে, সেই অগ্নিকুণ্ডের কেন্দ্রেই অবস্থান করছে টেক্সাস। খবর এসেছে, ট্রাম্প সরাসরি চাপ দিচ্ছেন টেক্সাসসহ রিপাবলিকান শাসিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে—তারা যেন নতুন মানচিত্র আঁকে, এমন মানচিত্র যা আগামী বহু বছর ধরে কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের আধিপত্য নিশ্চিত করবে।
শুধু টেক্সাসেই নয়, ইন্ডিয়ানা, মিসৌরি, নিউ হ্যাম্পশায়ার, সাউথ ক্যারোলাইনা ও ফ্লোরিডাতেও একই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই মানচিত্র পরিবর্তন আসলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল আগেভাগেই নির্ধারণ করে দেওয়ার কৌশল। ডেমোক্র্যাটরা বলছেন—এ যেন ‘খেলার মাঠ বাঁকিয়ে দেওয়ার’ চেষ্টা, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কেবল কাগজে-কলমে।
ট্রাম্প শুধু নির্বাচনী মানচিত্র পরিবর্তনেই থেমে থাকেননি। তিনি এখন প্রশ্ন তুলছেন আমেরিকার জনগণনার বৈধতা নিয়ে। জনগণনা থেকেই নির্ধারিত হয় কংগ্রেসীয় জেলার সংখ্যা ও বিভাজন। যদি জনগণনার ফলাফলই বাতিল করা যায়, তবে বিদ্যমান সব আসনবিন্যাস অচল হয়ে যাবে। সেই সূত্র ধরে ট্রাম্প দাবি করছেন, আগের জনগণনা গণনার সময় অভিবাসীদের সংখ্যা ভুলভাবে ধরা হয়েছে, ফলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই যুক্তিকে সামনে রেখে তিনি নির্বাচনী প্রক্রিয়াই বিলম্বিত বা স্থগিত করার এক বিপজ্জনক পথ রচনা করছেন বলে আশঙ্কা বাড়ছে।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে আলাস্কায়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ডাকযোগে ভোট এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতেও ভোট দেওয়া যাবে না। তাঁর ভাষ্য—পুতিনও নাকি মনে করেন ডাকযোগে ভোট গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। ফলে আগামী নির্বাহী আদেশে তিনি সরাসরি ডাকযোগে ভোট বাতিল করতে যাচ্ছেন। এই ঘোষণা প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি যেন এক প্রহসনমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করার প্রচেষ্টা, যেখানে ভোটার থাকবে, কিন্তু ভোটাধিকার থাকবে না।
ইতিহাসবিদ গ্যারেট গ্রাফ সতর্ক করে বলেছেন—“এটি হলো মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মৃত্যুপর্বের প্রথম ধাপ।” তাঁর মতে, ট্রাম্প নির্বাচন বাতিল করবেন না; বরং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবেন যেখানে ভোটারদের বাধ্য করা হবে কেবল সামনাসামনি ভোট দিতে। শহরের কেন্দ্রে অভিবাসন পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হবে, জাতীয় রক্ষী বাহিনী নামবে ‘নাগরিকত্ব যাচাই’ করতে—এভাবেই আসল গণতান্ত্রিক চর্চা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হবে।
প্রশ্ন উঠছে, আদৌ কি প্রেসিডেন্টের হাতে এ ধরনের ক্ষমতা আছে? সংবিধান স্পষ্ট করে বলছে, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ অঙ্গরাজ্য ও কংগ্রেসের হাতে। কোনো প্রেসিডেন্ট একক সিদ্ধান্তে ডাকযোগে ভোট বাতিল করতে পারেন না। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন বলছে—নির্বাহী ক্ষমতার আওতায় তিনি নির্বাচনী আইন প্রয়োগে কিছুটা স্বাধীনতা রাখেন। কিন্তু আদালত একাধিকবার তাঁর পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি এক ফেডারেল বিচারক রায় দিয়েছেন—“সংবিধান প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনের ওপর কোনো সরাসরি ক্ষমতা দেয়নি।”
আমেরিকার রাজনীতিতে এই নতুন অধ্যায়কে অনেকেই তুলনা করছেন ইতিহাসের অন্ধকার সময়ের সঙ্গে। যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর দমিত হয়, আর ভোটাধিকার কেবল কাগজে টিকে থাকে। ডাকযোগে ভোট যে আমেরিকান গণতন্ত্রকে সুদীর্ঘকাল ধরে সমৃদ্ধ করেছে, সেটিই আজ প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক কৌশলের বলি হতে চলেছে। বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—প্রাচীনতম গণতন্ত্র কি তবে নিজেই নিজের ভিত খুঁড়ে নিচ্ছে? নাকি জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই এই অশুভ ছায়াকে প্রতিহত করবে?